কম্পিউটার মাউসের ইতিহাস: কীভাবে মাউসের আবিষ্কার এবং উন্নতি ঘটেছে?

কম্পিউটার মাউস, আজকের আধুনিক কম্পিউটারের একটি অপরিহার্য অংশ, প্রযুক্তির ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। একে ব্যবহার করে কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা দ্রুত এবং সহজে বিভিন্ন কমান্ড বা অপশন বেছে নিতে পারে। কিন্তু এই যন্ত্রটির উৎপত্তি এবং উন্নতির পেছনের গল্পটি বেশ আকর্ষণীয়। মাউসের আবিষ্কার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক অপটিক্যাল এবং ওয়্যারলেস মাউসের আবিষ্কার পর্যন্ত এটি অনেক ধাপ পেরিয়েছে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা মাউসের ইতিহাস, আবিষ্কারক এবং বিভিন্ন পর্যায়ে এর উন্নয়নের ওপর আলোকপাত করব।

মাউসের আবিষ্কার: ডগলাস এনজেলবার্টের অবদান

১৯৬০-এর দশকে যখন কম্পিউটার প্রযুক্তি ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করছিল, তখন একটি নতুন ধরনের ইন্টারফেসের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। এই প্রয়োজনীয়তার প্রতিফলন ঘটে ডগলাস এনজেলবার্টের চিন্তাধারায়। ১৯৬৩ সালে, ডগলাস এনজেলবার্ট প্রথমবারের মতো একটি ডিভাইস তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে মাউস নামে পরিচিত হয়। এনজেলবার্ট স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (SRI) একটি গবেষণায় কাজ করার সময় এই ডিভাইসের ওপর গবেষণা শুরু করেন।

প্রথম মাউসের বৈশিষ্ট্য:

  • এনজেলবার্টের ডিজাইন করা প্রথম মাউসটি ছিল কাঠের তৈরি এবং এতে দুটি ধাতব চাকাও ছিল।
  • এটি একটি ছোট বাক্সের মতো দেখায় এবং একে বলা হতো “ইন্ডিকেটর”।
  • মাউসটি একটি তার দিয়ে কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত থাকত এবং এটি চালানোর জন্য ব্যবহার করা হতো একটি X-Y কোঅর্ডিনেট সিস্টেম।

“মাউস” নামের উৎপত্তি:

মাউস ডিভাইসটির নাম দেওয়া হয়েছিল “মাউস” কারণ এর আকৃতি দেখতে অনেকটা ছোট একটি ইঁদুরের মতো ছিল এবং এর পিছনে একটি তার ছিল যা দেখতে ইঁদুরের লেজের মতো মনে হতো।

মাউসের উন্নয়নের ধাপসমূহ

মাউসের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ঘটেছে, যা মাউসকে আরও উন্নত, কার্যকর এবং ব্যবহারযোগ্য করেছে। নিচে মাউসের কয়েকটি প্রধান উন্নয়নের ধাপ আলোচনা করা হলো:

১. বলযুক্ত মাউস (Ball Mouse) – ১৯৭০

১৯৭২ সালে বিল ইংলিশ, যিনি এনজেলবার্টের সহকর্মী ছিলেন, প্রথম বলযুক্ত মাউসের ডিজাইন করেন। এই মাউসটিতে একটি ছোট বল ব্যবহার করা হতো, যা পৃষ্ঠের সাথে ঘুরে কার্সরকে নড়াচড়া করতে সহায়তা করত। এটি বেশিরভাগ পৃষ্ঠে ভালো কাজ করত এবং এর প্রযুক্তি অনেকদিন ধরে ব্যবহৃত হয়েছে।

২. অ্যাপল মাউস – ১৯৮৪

১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে মাউসের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়। অ্যাপল কোম্পানি ১৯৮৪ সালে তাদের প্রথম ম্যাকিন্টশ কম্পিউটারের সাথে প্রথম বাণিজ্যিক মাউস বাজারে আনে। এটি ছিল বলযুক্ত মাউস, যার সাহায্যে গ্রাফিকাল ইন্টারফেসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা সহজে কম্পিউটার পরিচালনা করতে পারত।

৩. অপটিক্যাল মাউস – ১৯৯৯

১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো অপটিক্যাল মাউস বাজারে আসে, যা মাউসের ইতিহাসে একটি বড় পরিবর্তন আনে। অপটিক্যাল মাউস ব্যবহারকারীদের জন্য আরও নির্ভুল এবং কার্যকরী ট্র্যাকিং প্রদান করে। এতে বলের পরিবর্তে একটি LED আলো এবং সেন্সর ব্যবহার করা হয়, যা পৃষ্ঠের আলো প্রতিফলন করে কার্সর নিয়ন্ত্রণ করে।

৪. লেজার মাউস – ২০০৪

অপটিক্যাল মাউসের পরবর্তী ধাপ ছিল লেজার মাউস। ২০০৪ সালে প্রথম লেজার মাউস বাজারে আসে, যা অপটিক্যাল মাউসের তুলনায় আরও বেশি নির্ভুল ছিল। লেজার মাউস প্রায় যেকোনো পৃষ্ঠে কাজ করতে সক্ষম হয়, এমনকি গ্লাস বা চকচকে পৃষ্ঠেও।

৫. ওয়্যারলেস মাউস – ২০০০-এর দশক

মাউস প্রযুক্তির আরেকটি বড় অগ্রগতি ছিল ওয়্যারলেস মাউস। ওয়্যারলেস মাউস ব্যবহারে আর কোনো তারের প্রয়োজন হয় না, যা ব্যবহারকারীদের আরও স্বাধীনতা প্রদান করে। ব্লুটুথ এবং RF প্রযুক্তির মাধ্যমে এটি কাজ করে এবং ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের জন্য একটি জনপ্রিয় পছন্দ হয়ে উঠেছে।

আধুনিক মাউসের বৈশিষ্ট্য

Redragon M806 Bullseye Wired Gaming Mouse

আজকের দিনে, মাউস প্রযুক্তি আরও বেশি উন্নত হয়েছে এবং এতে অনেক নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দেওয়া হলো:

  • হাই DPI (ডট পার ইঞ্চি): মডার্ন গেমিং মাউস এবং প্রফেশনাল মাউসে উচ্চ DPI যুক্ত করা হয়েছে, যা মাউসের সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং আরও নির্ভুল নিয়ন্ত্রণ প্রদান করে।
  • প্রোগ্রামেবল বাটন: গেমারদের জন্য প্রোগ্রামেবল বাটন সম্বলিত মাউস তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ব্যবহারকারীরা তাদের পছন্দমতো কাজ সেট করতে পারেন।
  • এর্গোনোমিক ডিজাইন: ব্যবহারকারীর আরাম এবং স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে মাউসের নকশা আরও এর্গোনোমিক করা হয়েছে, যা দীর্ঘ সময় ধরে মাউস ব্যবহার করলেও ব্যবহারকারীর হাতের ক্লান্তি কমায়।
  • RGB লাইটিং: গেমিং মাউসগুলিতে RGB লাইটিং যুক্ত করা হয়েছে, যা দেখতে আকর্ষণীয় এবং ব্যবহারকারীদের পছন্দমতো আলোর রঙ পরিবর্তন করা যায়।

মাউসের ভবিষ্যৎ

প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে মাউসের উন্নতি থেমে থাকবে না। আধুনিক মাউসগুলি আরো সংবেদনশীল, নির্ভুল এবং বহুমুখী হয়ে উঠছে। মাউসের ভবিষ্যতে আমরা দেখতে পারি:

  • এআই ও স্মার্ট মাউস: ভবিষ্যতে এআই-চালিত মাউস আসতে পারে, যা ব্যবহারকারীর আচরণ শেখার মাধ্যমে আরও সহজে কাজ সম্পাদন করতে সহায়ক হবে।
  • ভিআর ও এআর ইন্টিগ্রেশন: মাউসের ব্যবহার আরও ইমারসিভ প্রযুক্তি, যেমন ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (VR) এবং অগমেন্টেড রিয়ালিটি (AR)-এর সাথে ইন্টিগ্রেটেড হতে পারে।

উপসংহার

কম্পিউটার মাউসের ইতিহাস একটি অসাধারণ যাত্রা। ১৯৬৩ সালে ডগলাস এনজেলবার্টের আবিষ্কার থেকে শুরু করে আধুনিক মাউসের অসংখ্য উন্নতির মধ্যে দিয়ে এটি ব্যবহারকারীদের জন্য আরও কার্যকরী এবং সুবিধাজনক হয়ে উঠেছে। মাউস প্রযুক্তির অগ্রগতি আজও অব্যাহত রয়েছে, যা আমাদের প্রযুক্তির ভবিষ্যৎকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

Shopping Cart